Responsive Ad Code Here

আইনস্টাইনের মস্তিস্কঃ কী ছিলো তাঁর অসীম মেধার রহস্য?


আইনস্টাইন!
নামটা শোনামাত্র মাথায় আসে ক্ষুরধার মস্তিষ্ক বিশিষ্ট একজন অসম্ভব মেধাবী মানুষের কথা। আশেপাশে তাই অসাধারণ জিনিয়াস কাউকে দেখলে আমরা তাকে আইনস্টাইনের সাথে তুলনা করি। আর আইনস্টাইনের এই অসম্ভব মেধার উৎস- তাঁর মস্তিষ্কটা নিয়েও মানুষের আগ্রহের নেই কমতি।

সেই সূত্রেই অনেকে হয়তো জানেন যে তাঁকে সৎকার করার আগেই তাঁর মস্তিষ্ক করোটি থেকে বের করে নেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু কী হয়েছিলো শেষ পর্যন্ত সেটার? বা সেটা নিয়ে গবেষণা করে তাঁর অপরিসীম মেধার কি কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়?

আইনস্টাইন মারা যান ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল, আমেরিকার নিউ জার্সির প্রিন্সটন হাসপাতালে। তখন তার বয়স ছিলো ৭৬। মৃত্যুর কারণ ছিলো Rupture of an abdominal aortic aneurysm থেকে সৃষ্ট রক্তক্ষরণ।

মারা যাওয়ার পর তার মরদেহ autopsy করার সময় হাসপাতালের প্যাথলজিস্ট ডা. থমাস হার্ভে চিন্তা করেন যে এরকম প্রতিভাধর একজন মানুষের মস্তিষ্ক এভাবে নষ্ট করে ফেলাটা অন্যায় হবে। তাই আইনস্টাইনের পরিবারের কারো অনুমতির তোয়াক্কা না করেই তিনি আইনস্টাইনের খুলি কেটে মস্তিষ্ক বের করে নেন। সেই সাথে বের করে নেন তার চোখ জোড়াও।


ড. হার্ভে দ্রুত সেগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে খবরটা জানান। স্বভাবতই আইনস্টাইনের পরিবার কাজটায় ক্ষেপে যায়। কিন্তু হার্ভি তাদেরকে এই বলে ঠাণ্ডা করেন যে কাজটা তিনি করেছেন নিখাদ বিজ্ঞানের স্বার্থে।

চোখ জোড়া ভরা জারটা দেওয়া হয় আইনস্টাইনের চোখের ডাক্তার হেনরি আব্রামকে। গুজব আছে যে তিনি সেটাকে নিউ ইয়র্কের কোথাও একটা সেফ ডিপোজিট বক্সে রেখে দিয়েছেন।

তবে মস্তিষ্কের গন্তব্য ওখানেই থেমে যায়নি। কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস অফ ফিলাডেলফিয়ার মিউজিয়াম কিউরেটর মারসি এঙ্গেলম্যান বলেন, প্রথমে মস্তিষ্কটাকে মোটামুটি ১ ঘন সেমি আয়তনের ২৪০টা টুকরো করা হয়। এরপর সেসব টুকরোর বিভিন্ন অংশ থেকে প্রায় ১ হাজার স্লাইড তৈরি করা হয়। সব শেষে বক্সে ভরে পাঠিয়ে দেয়া হয় পৃথিবীর নানান গবেষকদের কাছে।

যদিও হার্ভে বলেছিলেন যে কাজটা তিনি করেছিলেন বিজ্ঞানের স্বার্থে, আর মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণালব্ধ সব তথ্যই তিনি সবাইকে জানাবেন। কিন্তু এরপর প্রায় সাত দশক পার হয়ে যাওয়ার পরেও এ ব্যাপারে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।

তবে উনি যে স্লাইডগুলো বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়েছিলেন এবং যে ছবিগুলো তুলেছিলেন সেগুলো থেকে বেশ কিছু মজার তথ্য পাওয়া গিয়েছে।


  • আইনস্টাইনের IQ ছিলো ১৬০-১৯০। একজন সাধারণ মানুষের (১০০-১১০) চাইতে যা অনেক বেশি। কিন্তু তার মস্তিষ্কের আয়তন বা আকার ছিলো গড়পরতা মানুষের চাইতে ছোট। সবারটা যেখানে প্রায় ৩ পাউন্ড, আইনস্টাইনেরটা ছিলো ২.৭ পাউন্ড।


  • ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটির নৃবিজ্ঞানী ডিন ফক জানান, আইনস্টাইনের ইনফেরিওর প্যারাইটাল রিজিওন অন্য সবার চাইতে ১৫% বেশি বড়। মস্তিষ্কের এই অংশটা ভাষা এবং গানিতিক দক্ষতা নিয়ন্ত্রণ করে। 


  • ১৯৯৯ সালে হ্যামিল্টনের ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির একটা দল বের করে যে তাঁর ফ্রন্টাল লোব-এর (মস্তিষ্কের কপালের দিকের অংশ) ইনফেরিওর ফ্রন্টাল জাইরাস এর অপারকুলাম রিজিওনটা খালি। গবেষকেরা ধারণা করেন যে, এই অংশটা খালি থাকায় এখানকার নিউরনগুলো আরো বেশি ভালোভাবে সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছিলো।


  • আরও একটা anatomical পার্থক্য হচ্ছে তার মস্তিষ্কে একটা sulcus (মস্তিষ্কের ফাটলের মতো দেখতে জায়গাগুলো) ছিলো না। সেটা হচ্ছে Sylvian sulcus. আইনস্টাইন যে অন্যদের চাইতে একটু অন্যভাবে ভাবতেন, এই ব্যাপারটাকে সেজন্যে দায়ী করা হয়। 


  • গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে আইনস্টাইনের মস্তিষ্কে গ্লায়াল কোষ (Glial cell) নামে এক প্রকার কোষ সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কের তুলনায় বেশি ছিলো। ফলে মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশের সাথে সমন্বয় আর তথ্য আদান প্রদান খুব ভালো ভাবে হতো।


  • তাঁর মস্তিষ্কে Aging-এর তেমন কোনো ছাপ ছিলো না। পরীক্ষা করে দেখা যায় যে তার নিউরনে Lipofuscin নামের এক প্রকার যৌগের ঘাটতি আছে। এটা হলো বাদামী হলুদ বর্ণের এক প্রকার autofluroscent (যেসব জৈবিক পদার্থ আপনাআপনি আলোর নিঃসরণ করে)। যৌগটার কাজ আসলে কী; সেটা এখনো জানা যায়নি, তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে জীবকোষে এটা জমা হতে থাকে। কিন্তু ৭৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পরেও আইনস্টাইনের মস্তিষ্কে জিনিসটা ছিলো না বললেই চলে।


তবে মনে রাখতে হবে যে, এসব গবেষণার বেশিরভাগই হয়েছিলো ছবি দেখে আর কোনোটাই আইনস্টাইনের এরকম মেধার সঠিক কারণ ব্যাখ্যা করতে পারে না। ফলে অচিরেই ব্যাপারটা নিয়ে হৈ চৈ কমে যায়, এমনকি এই বিখ্যাত মস্তিষ্কটা মানুষের বিস্মৃতির আড়ালেই চলে যায় বলা যায়।

স্লাইড বানানোর পরে মস্তিষ্কের বাকি অংশটা একটা জার-এ ভরে একটা সিডার কাঠের বক্সে ভরে রাখা হয়। প্রায় ২০ বছর বক্সটা একটা দেরাজের ভিতর একটা বিয়ার কুলারের নিচে চাপা পড়ে ছিলো। ১৯৭৮ সালে সাংবাদিক স্টিভেন লেভি সেগুলো খুঁজে বের করেন। ২০১০ সালে ডা. হার্ভের বংশধরেরা জারটা প্রিন্সটন হাসপাতালে দান করে দেন।

আর বাকি ১ হাজার স্লাইডের তাহলে কি হলো?

এর মধ্যে একটা বক্স আছে ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ হেলথ অ্যান্ড মেডিসিন-এ। ফিলাডেলফিয়ার মাটার মিউজিয়ামে আছে ৪৬ টা আর বাকিগুলোর কোনো হদিস নেই।

ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ হেলথ অ্যান্ড মেডিসিন-এর শিকাগো শাখা আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের ছবিগুলো দেখার জন্যে একটি আন্ড্রয়েড অ্যাপ বানিয়েছে। সেটায় মস্তিষ্কের স্লাইডগুলোর ছবি আর তার বিভিন্ন দিক দেখা যায়। মাটার মিউজিয়ামে গেলেও দেখতে পাবেন ওখানকার স্লাইডগুলো।

সন্দেহ নেই হার্ভে যা করেছিলেন তা ছিলো সম্পূর্ণ অবৈধ আর অনৈতিক। কাজটা তিনি সম্ভবত বিজ্ঞানের স্বার্থেও করেননি, তবে আশা করা যায় যে বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে হয়তো আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের সত্যিকার রহস্য অচিরেই উদ্ধার হবে।

ও হ্যাঁ, চোখগুলো? সেগুলোর কী হলো?

৯০ এর দশকে গুজব রটে যে মাইকেল জ্যাকসন চোখগুলো ৫০ লক্ষ ডলার দিয়ে কিনতে চান। কিন্তু হেনরি আব্রাম সাফ জানিয়ে দেন যে সেগুলো বিক্রয়ের জন্য নহে! তাই এখন পর্যন্ত ধারণা করা হয় যে সেগুলো কোনো একটা সেফ ডিপোজিট বক্সে আজো সংরক্ষিত আছে।


অতিরিক্ত তথ্যঃ আইনস্টাইন ছাড়াও রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির লেলিন এবং গণিতবিদ কার্ল ফ্রেডারিখ গাউস-এর মস্তিষ্কও মৃত্যুর পর পরীক্ষা করার জন্যে বের করে নেওয়া হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ